বুধবার , ২৪শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
×

পাইলটের মৃত্যু প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত,কর্ণফুলীতে

পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার ‘সোর্ড অফ অনার’ পাওয়া মেধাবী অফিসার আসিম জাওয়াদ মারা গেছেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে । বিমানের অপর পাইলট উইং কমান্ডার সোহান হাসান খাঁন আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ বিমানের প্রশিক্ষণ বিমান ইয়াক (ওয়াইএকে)-১৩০ এ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আগুন ধরে গেলে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ এই দুর্ঘটনা ঘটে। বিমানটি পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের অদূরে কর্ণফুলী নদীতে নিমজ্জিত হয়। বিমানের দুই পাইলট প্যারাসুটের মাধ্যমে নেমে আসলেও পাইলট আসিম জাওয়াদ ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। স্কোয়াড্রন লিডার জাওয়াদের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামেও শোকের মাতম চলছে। গতকাল বিকেলেই ময়না তদন্ত শেষে লাশ স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে জাওয়াদের মা, সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক নিলুফার আকতার খানম এবং বাবা ডা. মোহাম্মদ আমান উল্লাহ বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। দুর্ঘটনার পর থেকে পতেঙ্গা এলাকায় বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি উদ্ধারের জন্য নৌবাহিনীর ডুবুরি, কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ, ফায়ার ফাইটাররা কাজ শুরু করেন। রাতে শেষ খবরে জানা গেছে যে, দুর্ঘটনা কবলিত যুদ্ধবিমানটি ১০ ঘণ্টার অভিযানের পর উদ্ধার করা হয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিমান বাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হকের এয়ার অধিনায়ক এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে এম শফিউল আজম, ওএসপি, জিইউপি, এনডিসি, পিএসসি ও নৌ বাহিনীর উদ্ধারকারী দল।

জানা যায়, বিমানের ভগ্নাংশ খুঁজে পেতে বিমান বাহিনীর আধুনিক উদ্ধার জাহাজ ‘বলবান’ বিমানের ভাঙা অংশ উদ্ধারে কাজ চালিয়েছে। এছাড়াও বিমানটি খুঁজতে বিশেষ ‘সোনার সিস্টেম’ও ব্যবহার করা হয়েছিলো।

পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী, আইএসপিআর এবং বিমানবাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমানের প্রশিক্ষণ বিমান ইয়াক–১৩০ নিয়ে গতকাল সকালে আকাশে উড়াল দেন পাইলট উইং কমান্ডার সোহান এবং পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ। বিমানটি ঠিকঠাকভাবে উড়াল দিলেও এক পর্যায়ে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। দুই পাইলট নিচে নেমে আসার সময় বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। এতে দুই পাইলটই প্যারাসুট দিয়ে নিচে নেমে আসেন। বিমানটি কর্ণফুলী নদীতে আছড়ে পড়ে। দুই পাইলটও নদীতে পড়েন। তাদের উদ্ধার করে দ্রুত বিএনএস পতেঙ্গাতে নেয়া হয়। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ সংঘটিত এই বিমান দুর্ঘটনার ঘণ্টা দুয়েক পর বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আসিম জাওয়াদ মারা যান। অপর পাইলট উইং কমান্ডার সোহানের অবস্থা স্থিতিশীল বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

আসিম জাওয়াদ বিয়ে করেন নারায়ণগঞ্জে। তার স্ত্রীর নাম অন্তরা আকতার। তাদের ছয় বছর বয়সী আয়াজ নামের একটি কন্যা সন্তান এবং মাত্র ৯ মাস বয়সী আয়াত নামের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে তিনি নগরীর পতেঙ্গাস্থ জহুরুল হক ঘাঁটিতে বসবাস করতেন। তার পিতা মাতা মানিকগঞ্জ জেলা সদরের গোল্ডেন টাওয়ারের ফ্ল্যাটে বসবাস করেন।

অসম্ভব মেধাবী আসিম জাওয়াদ স্কুল জীবন থেকে মেধার স্বাক্ষর রেখে আসছিলেন। জীবনে কোনো পরীক্ষায় তিনি কোনোদিন দ্বিতীয় হননি। তিনি সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি ও ২০০৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ– ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। জাওয়াদ ২০১০ সালে বাংলাদেশ এয়ারফোর্স অ্যাকাডেমিতে (বাফা) যোগদান করেন। তিনি ২০১১ সালে একজন পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ওই সময় প্রশিক্ষণে সামগ্রিকভাবে সেরা পারফরম্যান্সের জন্যে তিনি গৌরবমণ্ডিত সোর্ড অব অনার লাভ করেন। এসসিপিএসসি–থেকে এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র ‘সোর্ড অফ অনার’ বিজয়ী। ‘ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টরস’ কোর্সে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য তিনি অর্জন করেন সম্মানজনক ‘মফিজ ট্রফি’। এছাড়া তার দায়িত্বশীলতা ও কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার জন্য চিফ অফ এয়ার স্টাফ থেকে প্রশংসা পেয়েছিলেন।

স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ চঞ–৬ , খ–৩৯তঅ , ঋ–৭গই, ঋ–ইএ১ ইত্যাদি বিমান চালিয়েছেন। তিনি ছিলেন ঋ–৭গএ১ এর অপারেশনাল পাইলট ও এলিমেন্ট লিডার। ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে ’ জাতিসংঘের মিশনে শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। বিভিন্ন কোর্সে অংশ নিতে তিনি চীন, ভারত, তুরস্ক ও পাকিস্তান সফর করেছিলেন। তিনি ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টর’স স্কুল অফ বিএএফ–এ স্টাফ ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়না তদন্ত শেষে লাশ পরিবারের সদস্যদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এই সময় আসিম জাওয়াদের বাবা ডা. আমানুল্লাহ, ভগ্নিপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ কামালউদ্দিনসহ আত্মীয়–স্বজন উপস্থিত ছিলেন। গতরাত বাদ এশা জহুরুল হক ঘাঁটিতে মরহুম স্কোয়াডন লিডার আসিম জাওয়াদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ তার লাশ মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামে দাফন করা হবে।

এদিকে রাতে শেষ খবরে জানা গেছে যে, স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদের লাশ নিয়ে পরিবারের সদস্যরা মানিকগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন।

অন্যদিকে কর্ণফুলী নদীতে তলিয়ে যাওয়া ইয়াক–১৩০ বিমানটি অবস্থান শনাক্তের পর গতরাতে উদ্ধার করা হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ম্যাগনেট সম্বলিত বিশেষায়িত নৌযান দিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম চালায় বলে জানিয়েছেন নৌ পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আকরাম। বিমানটিকে টেনে কূলে নিয়ে আসা হয় বলেও সূত্র জানিয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিমান দুর্ঘটনার পর কিছু সময়ের জন্য বন্দর চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে পরবর্তীতে চ্যানেলে স্বাভাবিক জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে।

চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর সূত্র জানিয়েছে, যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় বিমান চলাচলে কোনো সমস্যা হয়নি। বিমানটি যেহেতু নদীতে বিধ্বস্ত হয়েছে তাই আন্তর্জাতিক এই বিমানবন্দরে স্বাভাবিকভাবে ফ্লাইট অপারেট করা হয়েছে।